প্রতিবাদী ভালোবাসার গল্প

প্রতিবাদী ভালবাসা
লবাসি তোমায় সংখ্যা

রক্ত পলাশ

অনিমেষের লাল মারুতি গাড়িটা হঠাৎ বেশ শব্দ করেই ব্রেক কষে,শৈশবের প্রিয় রায়নগরের মোড়ে,ঠিক মোহন কাকুর দোকানের সামনে।মোহন কাকু এই আমূল বদলে যাওয়া অনিমেষকে দেখে সেই পুরোনো পান খাওয়া ঠোঁটের হাসি দেয়।এই হাসির কোন জবাব নেই অনিমেষের কাছে,সত্যি কথা বলতে জবাব দেওয়ার সময়টাই নেই তার।নিম্নবিত্ত মুখস্ত মুখগুলো আর ভাল লাগে না অনিমেষের।সেই মুখগুলোতে শুধু আত্মীয়তার ঋণ শোধের বায়না।অসহ্য !!
তার বেনসনের প্যাকেটটা খালি পড়ে আছে,ড্রাইভিং সিটের পকেটে।সে ভরাপেটের মানিব্যাগের বুক থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে ড্রাইভারের হাতে দিয়ে চোখের ইশারায় কাজ বুঝিয়ে দেয়।একসময় অনিমেষ অনেক বেশি কথা বলত।কারণে অকারণে কথা বলত,হাসত।এখন আর কাজ ছাড়া কথা তেমন একটা বলে না।ইশারাতেই যখন সব হয় তখন আর কথা বলে লাভ কি?

আলোরিকা-সদ্য কথা বলতে শেখা তার আড়াই বছর বয়েসী মেয়েটা,আধো আধো ভাষায় সারাদিনমানই খুঁটিনাটি প্রশ্ন তাড়ায় তার দিকে-বাবা তুমি আমার মতো ছোট টুপি পড় না কেন?তুমি আমার মতো ছড়া বলতে পারো না কেন?ও বাবা তুমি সিগারেট খাও কেন?আমাকে দাও আমিও খাব।ও বাবা তোমার ঠোঁট কালো কেন,আমার ঠোঁট তো লাল?বাবা,তোমার মতো আমার মুখেও চুল উঠে না কেন?তুমি যখন আমাকে ওম্মা দিয়ে আদর কর,তখন ঐগুলা আমার গালে কাঁটার মতো লাগে,আমার কাতুকুতু লাগে,স্টুপিড বাবা।ও বাবা, মামণি কোথায় গেছে?মামণিটা তোমার সাথে শুধু ঝগড়া করে কেন?শেষ প্রশ্নে এসে বরাবরই থমকে যায় অনিমেষ।তার মনে পড়ে যায় আলোরিকার মায়ের কথা,অনিতার কথা।মনে পড়ে যায় অনিতার সাথে সংসারের প্রথম দিকের সুন্দর দিনগুলোর কথা,সাথে সাথে মনে পড়ে যায় ছোটখাট কিছু একটা নিয়ে বড়সড় মন কষাকষি, আর দুজনেরই হাতে সময়ের বড় অভাবের কথা।সময়ের আদরে এখন তারা আপাতত আলাদা।তাই সংসারের কোন কোন অবাঞ্চিত অশান্তির মূলে কার দোষ কতোটা সেই হিসেবটা একা একা কষতে গিয়ে একসময় ভেঙে পড়তে হয় অনিমেষকে।তাই শেষ প্রশ্নটা সযত্নে ‍এড়িয়েই যেতে হয় ছোট মেয়ের কাছে।প্রশ্ন করতে করতে মেয়েটা যখন ক্লান্ত হয়ে থেমে যায়,তখন অনিমেষ এককথায় সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়-“সোনা মা,আমি একটা ব্যাড বয়,তুমি একটা গুড র্গাল।”

ড্রাইভারটাকে সিগারেট আনতে পাঠিয়ে অনিমেষ আজকের এগ্রিমেন্টটার কথা ভাবছিল।জাপানী একটা কোম্পানির বেশ বড় একটা প্রপোজাল-প্রায় দেড় কোটি টাকার।ভাবতেই কেমন অনিমেষের চোখটা জ্বলজ্বল করে উঠল।সে স্বার্থের খেয়ালে লোভে জ্বলা চোখ নিয়ে থাই গ্লাসের জানলা পেরিয়ে রায়নগরের মোড়ের সেই পরিচিত কলতলাটাতে চোখ রাখল।একটা মেয়ে নিম্নবিত্ত হাতে একটার পর একটা কাপড় ধুয়ে যাচ্ছিল।দৃশ্যটা অনিমেষের অপরিচিত না।এই মেয়েটাও অনিমেষের অপরিচিত না।বরং খুব পরিচিত,হয়তো বা নিজের চেয়েও বেশি চেনে,বেশি জানে ঐ মেয়েটাকে।সুতপা।অনিমেষের প্রথম প্রেম।বাউন্ডুলে মধ্য ঊণিশে,সেই কবি আজাদের মতো করে,এই সুতপার মাঝেই একদিন অনিমেষ একজন রাবীন্দ্রিক প্রেমিকাকে খুঁজতে চেয়েছিল।দুঃসহ দুঃসময়েও যে গাইতে পারে;লিখতে না পারুক,অন্তত লেখাতে পারে;নাচতে না পারুক,অন্তত নাচাতে পারে! পরনে ধানি-রঙা শাড়ি,হাতে হলদে সবুজ চুড়ি,কেশদানিতে বেনামি ফুল, কর্ণলতিকায় কাঠগোলাপ পরে চোখাচোখি দাঁড়িয়ে নাকফুলের বেড়াজাল ডিঙিয়ে কাব্যিক কমান্ডারের ঢঙে যে হুকুম করতে পারে --'কী লিখেছ আমায় নিয়ে, তোমায় নিয়ে, আমাদের নিয়ে? সমর্পণ করো!'
এইসব তখনকার দেখা স্বপ্ন,যখন অনিমেষ কবিতা পড়ত,কবিতা লিখত,কবিতা খেত,কবিতায় ঘুমুত।দিনযাপনের চাঁদনীঘাটে বসে,বুকের বোতাম খুলে দাঁড়িয়ে থাকা কোন বখাটে বিকেলে, কুয়াশার ওড়নায় জলজ বুক ঢেকে রাখা উর্বশী সুরমার কোলে বসে ;সম্বোধনের আড়াই অক্ষরে প্রেমিকার নামটা নিয়ে ,ভুল বানানের প্রেমপত্র লিখত।মাছরাঙা রোদে ভিজে গিয়ে রোজ কবিতার অসুখে ভুগত।কখনো সখনো-একটা নিঃসঙ্গ দোয়েলের ভোরে জোড়া শালিকের গান গাইতে গাইতে ভালোবাসার গায়ে আদরের চিমঠি কাটত।চিলেকোঠার নীল জানালাটা আলগোছে খুলে দিয়ে কালো আকাশটারে খেরোখাতা করে নক্ষত্রগুণে সংখ্যাতত্ত্ব শিখত।অসীমের ঐ বেলোয়ারি সরোবরে তারাদের স্নান দেখে দেখে শাহরিয়ারের মতো করে পাঁজর নিংড়ে উচ্চারণ করতে পারত দু’চারটা চপল প্রেমের পংক্তি---------------

“আমার তারারা উজালা বালিকা
ঘন ঘন প্রেমে পড়ে,
একটি তারা ডুব দিয়ে উঠে
রাত্রির সরোবরে।”

অথবা
প্রথম প্রেমের রাজকন্যার এলোচুলের নৈর্ব্যত্তিক খোঁপা বাধা দেখে প্রেমিক ঠোঁটে বলে ওঠতে পারতো-------

“যে রাতে গুঁজেছো চুলে বেগুনি রিবন বাঁধা ভাট,
সে রাতে নরকও ছিলো প্রেমের তল্লাট।”----------------------

কিন্তু আজকাল অনিমেষের আর কবিতা ভাল লাগে না,আগের মতো আর কবিতা বুঝতে পারে না ।বিখ্যাত একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির অ্যানুয়েল রিপোর্ট পর্য্যন্তই আটকে থাকে সে।যদিও সে জানে,তার চারপাশের যে পরিচিত মানুষগুলো,তাদের মুখগুলোই একেকটা মৌলিক কবিতা।কিন্তু যার নিজের মুখটাই আয়নায় দেখা হয় না কোন কোন দিন, যার আধখাওয়া গ্লাসের জলে ডুবে থাকে দিনযাপনের কবিতা,সে কি করে ঐ মুখগুলোর ছবি পাঁজরে বাঁচিয়ে রাখবে!!

অনিমেষ অন্যমনে নীল স্মৃতির সরোদ বাজায়-কপালের নকশাতে ভজকট বেঁধে যাওয়াতেই কিনা সুতপা ঐ কলতলাতে আর অনিমেষ এই মারুতি গাড়িতে।পথের ধারের কলটাতে অনিমেষ সুতপাকে প্রায়ই সপ্তাহান্তের ময়লা কাপড়গুলো কাঁচতে দেখে।কে জানে,হয়তো বা সুতপাকে একনজর দেখার জন্যেই অনিমেষ রোজ এক জায়গায় গাড়ি থামায়।আবার মাঝে মাঝে দেখেও না দেখার ভান করে।অনিমেষ নিজের অজান্তেই ঘড়ির কাঁটার উল্টোপথে চলতে থাকে,তার মনে পড়ে যায়-
কতকিছু দেওয়ার ছিল তার সুতপাকে আর কত কিছুই না পাওয়ার ছিল !! সুতপার সেই আনকোরা হাতে রাঁধা পায়েসান্নের কথা মনে পড়ে যায় অনিমেষের।সুতপার কাছে পাওনা ছিল-কোন এক রাতে সংসারী উনুনে বউ বউ হাতে রাঁধা আলুর সুপ্ত,রোজ সকালে স্নানের পরে ভেজা চুলের সই সিঁথিতে সিঁদুরে লাল সুখ লালিমার,একজোড়া হাত শঙ্কজোড়া,রোজ বিকেলে সাজবে বলে কাজল টিপের বায়না ধরা----- আরও কত কি !! অনিমেষেরও সুতপাকে দেবার ছিল-আলতো করে ঘোমটা টানা ষোলআনা বাঙালিয়ানা,সংসারী সুখ মধ্যবিত্ত,সেই চিলেকোঠার নীল ঘরটায় গান কবিতার সংসারেতে প্রথম পাতার সত্ত্বাধিকার।একজোড়া অশ্রুহারা স্বপ্নালু চোখ,আর দশমীরাতে আঁধখানি চাঁদ সাথে সুহৃদ বন্ধু একটা তারা।কিন্তু দুর্বোধ্য নিয়তি ষোলগুটি খেলতে চাইল বলেই কি আজ সুতপা তার বউ হতে পারে নি !! অথচ আবেগের রোশনাই ছড়ানো মাতাল কৈশোরের শুরুতে একটা বিশুদ্ধ প্রেম নিয়েই এসেছিল মেয়েটা।সুতপার সবকিছুই ভাল লাগত অনিমেষের,শুধু অনুপস্থিতিটা ছাড়া।মনে পড়ে,প্রথম চিঠিটা কিন্তু সুতপাই লিখেছিল।শুরুতেই প্রথম প্রেমের বানান ভুল।তবু অনিমেষ ঠিকঠাক করেই পড়ে নিয়েছিলো।চিঠির উত্তরে সে কি লিখেছিল সেটা তার ঠিকই মনে আছে,তবু সে মনে করতে চায় না,হয়তো বা অন্য অনেকের মতোই ইচ্ছে করে কষ্ট কুড়াতে ভালবাসে না অনিমেষ।কিন্তু সুতপা যখন কয়েকদিন পর নিজের চিঠিটা নিজেই ফেরত নিতে এসেছিল তার কাছ থেকে,তখন কিন্তু সে অনিচ্ছেতেই কষ্ট কুড়িয়ে নিয়েছিল।সেদিন সুতপার কোনকিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না অনিমেষের কাছে।এখনও মাঝে মধ্যে ভুল করেই ভাবনা খেলায় অনিমেষ, সুবোধ বুঝি তার জন্যেই লিখেছিল------

Comments

Popular posts from this blog

গল্পঃ ম্যাডাম যখন Raj এর বউ

অপ্রকাশিত ভালবাসা গল্প ও কাহিনী